29 October, 2019

প্রথম দেখা সিংগাপুর

কথায় কথায় সরকারি লোকজন এই দেশটাকে সিংগাপুর বানায়ে ফেলার হুমকি দেয়। সেই কারণেই কিনা জানি না, সিংগাপুরে যাওয়ার তীব্র একটা ইচ্ছা ছিল।
গত বছর সিংগাপুর যাওয়ার একটা আকস্মিক সুযোগ হয়। ৫ দিনের সম্পূর্ণ প্রাইভেট ট্যুর।
ভিসা যেদিন সকালে পাইছি সেদিনই রাত ১২ টার মালিন্দো এয়ারলাইনসের টিকেট কাটি। টিকেটেই সব জমানো টাকা শেষ হয়ে যাওয়াতে ইমার্জেন্সি বিশ হাজার টাকা ধার নিয়া ছুটলাম সিংগাপুর।
মালিন্দো এয়ারলাইনসের ওই বিমানটা একদম নতুন ছিল। এয়ার হোস্টেসগুলাও নতুন। মনে হয় মাত্রই আকাশ থিকা পড়ছে। কিন্তু এই দেশের বেরসিক মশার কামড়ে এদের উদাম অংশ লাল হইয়া আছে সব এয়ার হোস্টেসের। বেশ কয়েকজন হাতে মশামারা ব্যাট নিয়া এদিক সেদিক দৌড়াইতেছে। প্লেনের ভেতর কোটি কোটি মশা। মনে হইতেছে এই দেশের জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করতেছে এরা।
কোনমতে যাত্রীরা উঠার সাথে সাথেই প্লেন ছেড়ে দেয়।
প্রায় চার ঘন্টা পর ক্যাপ্টেন জানালো আমরা মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আসছি। তাড়াহুড়ায় খেয়ালই করি নাই আমার টিকেট ট্রানজিট ছিল। প্রায় পাচ ঘন্টার ব্রেক টাইমে এয়ারপোর্টে ঘুইরা ফিরা কাটাইলাম। ঢাকা থেকে আসা বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাথে ইমিগ্রেশন বিভাগের কঠোর আচরণ ছাড়া সবই ভালো লাগছে।
সিংগাপুর এয়ারপোর্টে আসলাম প্রায় ফাকা বিমানে করে। আধা ঘন্টার মতো লাগছে মালয়েশিয়া থেকে।
ইমিগ্রেশনে সীল মারার আগমুহূর্তে অফিসার জিগাইলো সিংগাপুর কি জন্য আইছেন? নিশ্চয়ই মজা মারতে?
আমি কৈলাম, একটা সেমিনার আছে। এসজিএইচে।
অফিসার আমার ময়লা জামাকাপড়ের দিকে তাকায়া আর এন্ট্রি সীল দিলো না। সন্দেহ কইরা নিয়া গেলো গেস্টরুমে।
সেইখানে দুই ইয়াং অফিসার আইসা প্রায় বিশ মিনিট গল্প করলো, হাসাহাসি করলো। তারপর সন্দেহ দূর কইরা ছাইড়া দিলো। আরেক অফিসার আইসা একটা ট্যাক্সি ঠিক কইরা দিলো হোটেল অব্দি।
হোটেলে যাইতে যাইতে ড্রাইভারের সাথে কথা বলতেছিলাম আর সিংগাপুর দেখতে ছিলাম। আমার কষ্ট হইতেছিলো ট্যাক্সি নিয়া। ভাড়া কতো আসে আল্লাহই জানে!
ড্রাইভার আমার লোকেশন চেনে না, আমিও ঠিকমতো কইতে পারতেছিলাম না। ওইখানের এক বন্ধুর নাম্বার দিলাম। সে লোকেশন বলে দিলো ড্রাইভারের মোবাইলে। শেষমেশ ভাড়া আসলো ২১.৫০ ডলার! প্রায় ১৩০০/- টাকা। কিন্তু ড্রাইভার আমাকে অবাক করে দিয়ে ২০ ডলার রাখলো! মোবাইলের টাকাও নিলো না!
আমি ছিলাম একটা ৪০/- ডলার দামের মোটামুটি মানের হোটেলে। ব্যাকপ্যাকারদের জন্য এই আদর্শ।
দোতালায় হোটেল ছিল।
আমাদের হোটেলের নিচেই প্রচুর ছোট ছোট ঘর ছিল। সন্ধ্যার পরে এসব ঘর/বাসা/হোটেল গুলাতে স্বল্পবসনা হাস্যোজ্জ্বল মেয়েরা ডাকাডাকি করে। ছেলেদের দেখলেই দুই আঙুল দিয়া ভি এর মতো একটা চিহ্ন দেখায়। এর অর্থ বিশ ডলার। কতটুকু অব্দি বিশ ডলার সেইটা ক্লিয়ার না।
তবে সন্ধার পর শতশত বাংলাদেশী এইসব ঘরের সামনে ব্যাংকের টাকা তোলার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। সেরকম একজনের সাথে কথা বললাম।
সে একজন কন্সট্রাকশন লেবার। মাসে আয় ৫৬-৬০ হাজার টাকা। বাড়ীতে পাঠায় ২৫-৩০ হাজার। বাকিটাকা ও-ই ছোট্ট ঘরে থাকা এক মেয়ের পিছনে খরচ করে। ওইটা নাকি তার বান্ধবী! সে জানালো প্রায় বাংলাদেশীরই এমন একটা দুইটা বান্দবী আছে!
তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বলতে গেলে এইসব পরীদের দেখলে যে কোন ফইন্নিই বান্দবী বানাইতে চাইবে আরকি! 😋
সিংগাপুর ছোট্ট দেশ। আমি দুই দিনে প্রায় সবটাই ঘুরলাম। মেরিনা বে নামে একটা জনপ্রিয় জায়গা আছে। খুবই ছোট্ট বীচ আছে। আমি বীচের চেয়েও ছোট্ট প্যান্ট পইড়া নামছিলাম। এইখানে ম্যায়েরা প্রায় খালি গায়ে বীচে ডুব দিয়া থাকে। পাশেই সুইমিং পুল আছে। বিয়ার বা হার্ড ড্রিংক খাইলে নামতে দেয়। কিন্তু টাকার স্বল্পতায় আমি নামি নাই।
সিংগাপুর বাইরে থিকা দেখলে মনে হয় মানুষ নাই। আর পাতাল ট্রেনে (মেট্রোরেল) গেলে দেখা যায় পিপড়ার মতো মানুষ। তবে কোন ধাক্কাধাক্কি নাই। ওদের মেট্রোরেল নিচের দিকে তিন তলা। পুরা সিংগাপুরে ঘুরা যায়। দশ ডলার দিয়া একটা কার্ড কিনলেই হইলো। কোন চেকার/গার্ড নাই কোথাও।
মোস্তফা প্লাজা নামে একটা জায়গা আছে। বাংলাদেশীরা বেশীরভাগই এইখানে থাকে। পুরা সিংগাপুরে এই জায়গাতেই কেবল পুলিশ দেখলাম।
চায়না টাউন নামে দুনিয়ার সবজায়গায়ই একটা করে এলাকা থাকে। সিংগাপুরেও আছে। আমি গিয়ে দেখি মিনি চায়না! সবাই চাইনিজ৷ খাচ্ছে চাইনিজ স্টাইলে। রাস্তাঘাট, বাড়ীঘর চাইনিজ স্টাইলে। ভীষণ ভাল্লাক্সে। সবচে ভাল্লাক্সে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকা পুতুলের মতো চাইনিজ মেয়েগুলারে!
সিংগাপুরে চারদিন ঘুরেছি পথে পথে। একটা সাদা টিশার্ট আর একটা সাদা ফুলহাতা শার্ট ছিল। ঢাকায় আসার পরেও যাওয়ার সময় যেমন ঝকঝকে ছিল তেমনই পেয়েছি।
একদিন প্রচন্ড বৃষ্টি নামে, একেবারে আকাশ ফুটা হওয়া ঢল। ভাবছিলাম নৌকায় ভরসা রাখতে হবে। কিন্তু বৃষ্টি থামার দুই মিনিটের মাথায়ই রাস্তা ঝকঝকে। বৃষ্টির পানির কোন চিহ্নও পেলাম না।
এখানে সন্ধ্যা হয় রাতে। মানে দিনের/সূর্যের আলো থাকে রাত ৮/৯ টা অব্দি। রাত ১২ টার পরে রাস্তার মেরামতের কাজ শুরু হয়। রাস্তাঘাট সবই ভালো, তবুও কিসের জন্য কাজ করে বুঝি নাই। সম্ভবত মারিং করে আরকি! 
সিংগাপুরিয়ানরা চাইনিজ নিউ ইয়ার পালন করে ঘটা করে। ভাগ্যক্রমে আমরাও পেয়েছিলাম।
ওইদিন বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় প্রকাশ্যে। সম্মিলিত ওই অনুষ্ঠানে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের অদ্ভুত সব শারীরিক কসরত, নাচ আর গান শোনানো হয়।
আমরা তিনজন ওই অনুষ্ঠান দেখছিলাম। স্থানীয় এক মেয়ে এসে আমাদের ওই অনুষ্ঠান কেমন লেগেছিল, সিংগাপুর কেমন লাগলো, কোথাও কোন ঘাটতি আছে কিনা, সিংগাপুর নিয়ে আমার কোন পরামর্শ আছে কিনা এইসব জানতে চেয়ে একটা ফর্ম ফিলাম করলো। শেষে একটা 'নাইস' কলম গিফট করে একটা সাইন নিলো।
সবচে মজা লাগলো যাওয়ার আগে টানা ত্রিশ সেকেন্ড গভীরভাবে হ্যান্ডশেক করে দেয়। 😎😋

No comments:

Post a Comment