04 December, 2019

সাদা হাতীর দেশ: থাইল্যান্ড ভ্রমণ (পর্ব - ২)

মাদাম তুসো জাদুঘর Siam Discovery –তে অবস্থিত। আমরা বিটিএস বা স্কাইট্রেন ধরে যাবো এইজন্য বেজমেন্ট ফ্লোরে নেমে গেলাম। আমাদেরকে যেতে হবে Siam স্টেশনে। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে Siam পর্যন্ত সরাসরি কোনো ট্রেন নেই। তাই আগে আমাদেরকে Phaya Thai স্টেশনে গিয়ে নামতে হবে। Phaya Thai স্টেশনে গিয়ে Siam অভিমুখী ট্রেনে উঠে পড়লাম।
ব্যাংকক পৃথিবীর ব্যস্ততম একটি শহর। প্রতি বছর প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক এই শহরটা ভিজিট করে তাই এটি World's Most Visited City হিসেবে পরিচিত। এই কথার প্রমাণ মিলবে এয়ারপোর্টে ঢোকার সাথে সাথেই। ট্রেনে উঠেও স্থানীয়দের বদলে বিদেশিই বেশি চোখে পড়ে। অবশ্য আমার চোখে সবাই এখন বিদেশি। কি সুন্দর মানুষ! এমন বড় এবং ব্যাস্ত শহরটার ট্রাফিক সিস্টেম কত চমৎকার। উপর থেকে ঘরবাড়ী গুলোও খুব সাজানো গোছানো দেখা যায়। আমার সবচেয়ে চোখে বাধে রাস্তাঘাট এবং ট্রাফিক সিস্টেম। সুন্দর রাস্তা দেখলে আমি আপ্লুত হয়ে যাই। আমাদের হাতীর ঝিলের রোডটাতেও এক রকম প্রশান্তি লাগে কারণ এত এত ভাঙাচুরা রাস্তার ভিড়ে হাতীর ঝিল এখনো সুন্দর আছে। তাই স্কাইট্রেনে চড়ে আমি কেবল রাস্তাঘাটই দেখছিলাম।
Phaya Thai নেমে ট্রেন বদল করে উঠে পরলাম Siam যাওয়ার ট্রেনে। স্টেশনের এক্সিট থেকেই
Siam Paragon চোখে পড়ে। ওটার ভেতর দিয়ে হেটে গেলে Siam Center তারপর Siam Discovery যেটার চতুর্থ তলায় রয়েছে মাদাম তুসো মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামে ঢুকতে এক হাজার থাই বাথ লাগে। পার্কিং-এ অবস্থিত সেভেন ইলেভেন শপ থেকে নিয়ে নিলাম একটি ডিট্যাক (DTAC) সিম। এই সিম থাকলে এন্ট্রি টিকেটে ৩০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে। তবে আগেই অনলাইনে ক্লুকে বুকিং দিলেও এই ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে।
মাদাম তুসো জাদুঘরে রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব মানূষের মোমের মূর্তি। লন্ডনের মূল মাদাম তুসো মিউজিয়ামের একটি শাখা হল ব্যাংককের মাদাম তুসো মিউজিয়াম। আমার ধারণা অনুযায়ী দক্ষিন এশিয়া বা এশিয়া অঞ্চলে বেশি জনপ্রিয় এবং আলোচিত মানুষেরা প্রাধ্যান্য পেয়েছে ব্যাংককের এই জাদুঘরে। এমনকি বাহুবলি সিনেমার প্রভাসের একটি মূর্তিও শোভা পাচ্ছে এই মাদাম তুসোতে। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস তারকাসহ জনপ্রিয় সব ক্রীড়া তারকা, হলিউড বলিউডের হিরো হিরোইন, গায়ক গায়িকা, বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী অনেকের মূর্তিই আকর্ষণীয় করে তুলেছে জাদুঘরটিকে। এখানে ছবি তোলা কিংবা ভিডিও করা যাবে। এন্ট্রি টিকেট দিয়েই দশ মিনিটের চমৎকার 4D মুভিও ফ্রিতে দেখতে পারবেন।
সিয়ামের যে তিনটি সারি সারি বিল্ডিং এখানে রয়েছে সময় থাকলে ঘুরে দেখতে পারেন। মনোমুগ্ধকর ডেকোরেশন। থাইল্যান্ডের সর্বত্র ঐতিহ্যবাহী থাই শিল্পের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে থাইদের নীতিই হয়তো আর্ট দিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করা। কেননা থাই জিডিপির বড় একটা অংশ এই পর্যটন খাত থেকে আসে।
মিউজিয়ামে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে সাতটা বাজলে দৌড় দিলাম ডন মুইয়াং এয়ারপোর্ট। তবে সিয়াম থেকে সরাসরি ডন মুইয়াং পর্যন্ত বাস বা ট্রেন নেই। এখান থেকে ডন মুইয়াং যাওয়ার জন্য MBK
বাসস্টপে আসতে হয়েছে। এই স্টপেজ থেকে দুইটা বাস ডন মুইয়াং যায়। একটা হলো ২৯ নাম্বার বাস। আরেকটা নাম্বার মনে নেই, কেউ সাজেস্টও করেনি কিন্তু সাইনবোর্ডে দেওয়া আছে।
ডন মুইয়াং পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি যদিও আমরা ব্যাংককের ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে বেশ ভয়ে ছিলাম। থাই লোকজন ইংরেজি কেউ কম জানে কেউ জানেই না এই চক্করে পড়ে বাসস্টপ খুঁজে পেতে দেরি হয়েছে। সামান্য ভুল ইনফরমেশনের কারনে সিম কেনার আগে আমাদের ১ ঘন্টা নষ্ট হয়েছে। গুগল লোকেশন বলতে পারলেও কোথায় কি আছে সেটা স্থানীয়রা ভালো বলতে পারে। থাই লোকেরা তথ্য দেওয়ার বেলায় খুবই আন্তরিক। একজন ইংরেজি না বুঝলে অন্যজনকে ডেকে আনে। তবে বাসে চলাচল করার ক্ষেত্রে বাস নাম্বার জানা থাকা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ।
রাতেরবেলা বলেই কিনা জানিনা ডন মুইয়াং এয়ারপোর্ট সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টের চেয়েও বড় এবং সুন্দর মনে হচ্ছিলো। বোর্ডিং-এর আগ অব্দি শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। দৌড়াদৌড়ি করে পা তখন ব্যথা। আপনারা যারা খুব বেশি হাটাহাটি করে ঘুরতে চান তাদের জন্য আবশ্যকীয়ভাবে ফুট ম্যাসেজ নেওয়ার অনুরোধ থাকলো। ঢাকার মতো হাটতে মন না চাইলেই রিকশা সিএনজি মিলবে না। ছোট্ট যে যানবাহন টুকটু্ক আছে ওটার ভাড়া শুনলে বাজেট ট্রাভেলারদের মাথা ঘুরবে। সময় বাচাতে যদিও একবার চড়তে হয়েছে আমাদের। আর রাইড শেয়ার টুরিস্টের জন্য কেমন এটা আমার জানা নেই।
এয়ারপোর্টে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাত পার করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই। দীর্ঘক্ষণ এয়ারপোর্টে থাকার প্রয়োজন হলে অবশ্যই শীতের কাপড় সাথে রাখবেন। থাইল্যান্ডের গরম আবহাওয়ায় দরকার নেই ভেবে আমি অবশেষে শাড়ী জড়িয়ে শুয়েছিলাম। কারণ এয়ারপোর্টের তাপমাত্রা খুবই কম থাকে, শীত প্রধান দেশ থেকে হুট করে এসেই কেউ যেনো গরমে না পড়ে।
দৌড়ের উপর থাকার কারণে আমাদের খাওয়া বাদ পড়েছে। আপনারা খাওয়াটাকে একটু গুরুত্ব দেবেন। এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে বাইরে থেকে খাবার কিনে নেবেন। আমাদের এখনকার ফ্লাইটের সাথে খাবার নেই।
সাড়ে নয়টার দিকে বোর্ডিং পাস নেওয়ার ঢাক পড়ে। আমি এতক্ষণ চোখ পিট পিট করে সুন্দর সুন্দর মানুষ দেখছিলাম। তাদের কথা শুনছিলাম যদিও কিছু বুঝিনা। ডাক শুনে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। বর্ডিং পাস নেওয়ার সময় মেয়েটা বিশেষভাবে আমাকে ধন্যবাদ দিলো কেনো আমি জানিনা। উত্তর দেওয়ার ভারটা সঙ্গীর উপর ছেড়ে এগিয়ে গেলাম। সত্যি বলতে এত সুন্দর ছেলেমেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। শুনতাম ইউরোপিয়ানদের কেবল চামড়া সাদা হয় কিন্তু তারা সুন্দর হয় না। এই কথা একেবারেই মিথ্যে মনে হলো আর তাদের আন্তরিকতা দেখে কেবলই মুগ্ধ হয়েছি। এখানে সাদা আর কালোর ভেদ নাই, আমরা সবাই ট্যুরিস্ট। এমন এখখানা ভাব থাকে সবার।
Air Asia –র এই ফ্লাইটে সাউথ এশিয়ার কেউ নাই। আমরা দুজন মাত্র বাংলাদেশি। থাই বা কোরিয়ানও রেসের মানুষও হাতে গোনা। আমি যেহেতু একেবারে শেষের দিকে বসেছি তাই যাওয়ার সময় সবাইকে দেখেছি। এক ট্রাভেলার ভাই জানালো সেও ক্রাবি যাওয়ার সময় এটা নোটিস করেছে।
বিমান টেক অফ করছে নিচে আলোক ঝলমলে ব্যাংকক শহর। একটা শহর কতটা উন্নত সেটা নাকি রাতের আলো দেখেই বোঝা যায়। এত সুন্দর সাজানো আলো আমি দিল্লি কলকাতাতেও দেখিনি। দুনিয়ায় না জানি আরো কত সুন্দর জিনিস দেখা বাকী আছে...
------
*পরের পর্বে থাকবে ক্রাবি শহর, অনাং বিচ এবং ফি ফি আইল্যান্ডের ট্রান্সপোর্ট নিয়ে বিস্তারিত।
*সুবর্ণভূমি থেকে কোথায় কিভাবে যাবেন সেটা নিয়ে আমার ছোট্ট গাইডলাইন।
(উল্লেখ্য, আমি কোনো ট্রাভেল বা টিকেট এজেন্সি নই, সাধারন ট্রাভেলার হিসেবে আমার জানাশোনার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবেই। আমার অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন দেশি বিদেশি ব্লগ/ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যগুলোই আমি শেয়ার করবো যেটা আমার কাজে লেগেছিলো। সস্তায় ঘুরুন, সস্তায় টিকেট এরকম বিজ্ঞাপন দিতে আসিনি আমি। আপনি আমার চেয়ে ভালো তথ্য জেনে থাকলে রেফারেন্সসহ শেয়ার করবেন কিন্তু খোঁচা দিয়ে কমেন্ট করবেন না, তাতে আমার মতো সাধারণ ট্রাভেলার বিভ্রান্ত হবে।)
#সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট-এ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সবই পাওয়া যাবে ফার্স্ট ফ্লোর থেকে। তবে স্কাইট্রেনে যেতে চাইলে আপনাকে বেজমেন্ট ফ্লোরে নামতে হবে। সবচেয়ে সস্তায় এবং দ্রুত যেতে চাইলে ট্রেনই বেস্ট।
#সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাংককেই থাকতে চাইলে চলে যাবেন সুখুম্ভিত এরিয়ায় যেখানে বেশীরভাগ বাঙালী থাকে। সুখুম্ভিত যেতে হলে আপনাকে বাস কিংবা বিটিএস স্কাই ট্রেন কিংবা ট্যাক্সি ধরতে হবে। এয়ারপোর্ট বাস ভাড়া প্রায় ২০০ বাথ, ট্রেনে ভাড়া ৫০ বাথ এবং ট্যাক্সি নিতে চাইলে ভাড়া পড়বে ৩০০-৪০০ বাথ।
#ব্যাকপ্যাকারদের জন্য সেরা জায়গা খাওসান রোড যেতে ধরতে হবে শাটল বাস। ভাড়া পড়বে ৬০ বাথ। অথবা বিটিএস স্কাইট্রেনে ৪৫ বাথ দিয়ে ফায়া থাই যেতে হবে আগে। এরপর ৫৯ নাম্বার বাসে করে চলে যাবেন খাও সান রোড। ভাড়া পড়বে ১০-৩০ বাথ। বেশি আরামে যেতে চাইলে খরচ পড়বে এক্টু বেশী, যেতে হবে ট্যাক্সিতে করে। ভাড়া পড়বে ৩০০-৪০০ বাথ।
#ফুকেট কিংবা ক্রাবি যেতে চাইলে বাস পাবেন ফুকেট বাস টার্মিনা্ল ২ থেকে। ভাড়া পড়বে ৭০০-১০০০ থাই বাথ। ফুকেট কিংবা ক্রাবিতে এয়ারে যাওয়া বেস্ট। সেক্ষেত্রে আগেই টিকেট কেটে রাখলে খরচ পড়বে বাসের চেয়েও কম।
#সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট থেকে ডন মুইয়াং এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য রয়েছে ফ্রি শাটল বাস। বাসটি প্রথম তলার চার নাম্বার ডোর থেকে ছেড়ে যায়। এছাড়াও অন্য বাসে যপ্যা যাবে, ভাড়া পড়বে ৩০ বাথ। চাইলে স্কাইট্রেইনে করেও এয়ারপোর্ট যাওয়া যাবে। এইজন্য ৪৫ বাথ দিয়ে আগে ফায়া থাই যেতে হবে এরপর মো চিট গিয়ে বাস ধরতে হবে। অথবা ফায়া থাই থেকেই ১৫০ বাথ বাস ভাড়া দিয়ে ডন মুইয়াং যাওয়া যাবে। আরো বেশি কমফোর্ট জার্নির জন্য রয়েছে পেইড এয়ারপোর্ট বাস সার্ভিস। দ্রুত যেতে চাইলে নিয়ে নিতে পারেন ট্যাক্সি সেক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হবে ৪৫০ বাথ ।
#সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট থেকে পাতায়া যাওয়ার জন্য বেস্ট অপশন হলো এয়ারপোর্ট টু পাতায়া বাস সার্ভিস। ওয়ান ওয়ে টিকেটের জন্য খরচ পড়বে ১২০ থাই বাথ। সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টের গেট ৮ থেকে বাস ছেড়ে যাবে। এরপর নর্থ পাতায়া রোডের পাতায়া স্টেশনে নামিয়ে দেবে। ট্যাক্সি নিয়ে গেলে খরচ হবে ১১০০ বাথ।
#সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট থেকে মাদাম তুসো মিউজিয়ামে যেতে চাইলে স্কাইট্রেনে করে আপনাকে প্রথমে Phaya Thai স্টেশনে গিয়ে নামতে হবে। ভাড়া জনপ্রতি ৪৫ থাই বাথ। এরপর Siam স্টেশনে যাওয়ার জন্য আলাদা ট্রেন ধরতে হবে। এখানে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২৫ থাই বাথ। Siam স্টেশনে নেমে হেটে হেটে Siam Paragon এবং Siam Center পার হলেই পেয়ে যাবেন Siam Discovery যেটার চতুর্থ তলায় রয়েছে মাদাম তুসো মিউজিয়াম।

No comments:

Post a Comment